সিরাজুর রহমান#
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রের রূপান্তরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি (R&D)। এখন আর শুধু অস্ত্র আমদানি নয়—বরং নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা অর্জনই হয়ে উঠেছে শক্তিধর দেশগুলোর প্রধান কৌশল। ফলে বর্তমানে বিশ্বের মোট সামরিক R&D খাতে বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া বর্তমান সময়ে কোনো দেশ নিজের সীমানা রক্ষা বা বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে পারে না। নতুন অস্ত্র বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে শত্রুর সম্ভাব্য আগ্রাসন প্রতিরোধ সহজ হয়। আজকের যুদ্ধ আর শুধু সৈন্য ও ট্যাংকের ওপর নির্ভর করে না; এটি এখন সাইবার যুদ্ধ, ড্রোন হামলা, স্পেস-ভিত্তিক নজরদারি, ও AI চালিত অস্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে আধুনিক প্রযুক্তি অবশ্যই প্রয়োজন মনে করে দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র:
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান (SIPRI, CSIS, US DoD Budget 2024) অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক গবেষণায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, যার বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১৪৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল বাজেটের মূল ফোকাস থাকে হাইপারসনিক প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, পারমাণবিক অস্ত্র, সাইবার সিকিউরিটি এবং মহাকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়।
চীন:
একবিংশ শতাব্দীতে চীন দ্রুতগতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। যদিও তাদের নির্দিষ্ট সামরিক গবেষণা বাজেট গোপন রাখা হয়, বিশ্লেষকদের মতে তারা প্রতি বছর প্রায় ৮০–৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। বিশেষভাবে AI চালিত ড্রোন, হাইপারসনিক মিসাইল, পরমাণু অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উন্নয়নে চীনের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য।
রাশিয়া:
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সামরিক বাজেট বাড়ালেও R&D খাতে তুলনামূলকভাবে কম ব্যয় করে—প্রায় ১৮–২০ বিলিয়ন ডলার। পারমাণবিক অস্ত্র, হাইপারসনিক মিসাইল, ড্রোন, সাবমেরিন ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তি আধুনিকায়নে তাদের মূল জোর।
ভারত:
ভারত বর্তমানে প্রতি বছর সামরিক গবেষণায় ৫–৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। DRDO, HAL এবং BEL হচ্ছে ভারতের প্রধান প্রতিরক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মোট ৭৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় গবেষণায় বিনিয়োগের হার এখনো সীমিত।
ইউরোপীয় শক্তি:
এদিকে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স সম্প্রতি R&D খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ শুরু করেছে। ২০২৪ সালের অনুমান অনুযায়ী, এ দেশগুলো এককভাবে ৬–৯ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সামরিক গবেষণায় ব্যয় করছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া:
চীন ও উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবিলায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখন প্রতি বছর ৭.৫–৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। AI সেন্সর, রোবটিক্স, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় এসব দেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়।
তুরস্ক:
তুরস্ক এখন প্রতি বছর ৩–৪ বিলিয়ন ডলার R&D খাতে ব্যয় করছে। বায়রাক্তার ড্রোন, TF-X যুদ্ধবিমান, জ্যামার, লেজার প্রযুক্তি ও দেশীয় মিসাইল উন্নয়নে তুরস্কের আত্মনির্ভরতা বেড়েছে।
ইসরায়েল:
ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সামরিক উদ্ভাবনী দেশ। তাদের বার্ষিক R&D বাজেট ৫–৬ বিলিয়ন ডলার, যা আয়রন ডোম, মাল্টি-লেয়ার ডিফেন্স এবং AI প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় হয়।
ইরান:
ইরান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রতি বছর আনুমানিক ১.৫–২ বিলিয়ন ডলার সামরিক গবেষণায় ব্যয় করে। মূলত মিসাইল, ড্রোন এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার উন্নয়নে তাদের জোর বেশি।
পাকিস্তান:
পাকিস্তান প্রতি বছর সামরিক R&D খাতে ৮০০ মিলিয়ন থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করে। পরমাণু সক্ষমতা বজায় রাখা, মিসাইল ও ক্ষুদ্র অস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নে দেশটি কাজ করে যাচ্ছে, যদিও বাজেট সীমাবদ্ধতা এবং বৈদেশিক নির্ভরতা তাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে বৈশ্বিক পর্যায়ে সামরিক আধুনিকায়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কোন দেশ কতটা গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করছে তার ওপর। শুধু অস্ত্র কেনা নয়, বরং নিজস্ব প্রযুক্তি তৈরি করাই হচ্ছে কৌশলগত নিরাপত্তা ও টেকসই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় শিক্ষা—প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ছাড়া শুধু আমদানি নির্ভর প্রতিরক্ষা কখনোই টেকসই নিরাপত্তা দিতে পারে না।
তথ্যসূত্র:-SIPRI Military Expenditure Database 2024, CSIS Defense Budget Tracker,US Department of Defense RDT&E FY2024.Jane’s Defence Weekly,GlobalData Defence Insights,RAND Corporation Reports
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.