সিরাজুর রহমান#
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দার মাঝেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নজিরবিহীনভাবে সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করছে। এই প্রবণতার বিরূপ প্রভাব গত ২০২২ সাল থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করে। বিশেষত ইউরোপ, এশিয়া-প্যাসিফিক এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক বাজেট ১৪০% থেকে ৩০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে কিংবা করছে। তাছাড়া বর্তমানে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের আনুমানিক ৪০–৪৫% সরাসরি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে।
আন্তর্জাতিক সামরিক গবেষণা সংস্থা SIPRI (Stockholm International Peace Research Institute)–এর তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সামরিক খাতে ব্যয় হয়েছে ২.৪৪৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ২০২৪ সালে এই ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২.৫৬ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চলতি ২০২৫ সালে তা বেড়ে হতে পারে প্রায় ২.৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আর এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে কিনা প্রায় ৪.৯%।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স (DoD) এর দেয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র চলতি ২০২৫ সালের জন্য সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে ৮৪৯.৮ বিলিয়ন ডলার এবং কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ও আধুনিক ফ্যাসিলিটির জন্য আলাদাভাবে আরও প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে বলে জানানো হয়।
অন্যদিকে, রাশিয়া চলতি ২০২৫ সালের জন্য অনুমোদন করেছে ১২৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার বেশি। তবে আল জাজিরার মতে, রাশিয়ার প্রকৃত সামরিক ব্যয় হতে পারে ১৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিছু বিশ্লেষকের মতে, এই ব্যয় ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে। রাশিয়া এরই মধ্যে ইরান, চীন ও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানি করছে এবং হাইপারসনিক ও পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকায়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীন চলতি ২০২৫ সালে আনুমানিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (১.৭৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান) সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় ৭.২% বেশি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামরিক গবেষণামূলক সংস্থাগুলোর মতে, চীনের প্রকৃত ব্যয় হতে পারে ৩৫০–৪৭১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত, কারণ দেশটি তার প্রকৃত সামরিক ব্যয় গোপন রাখতে চায়।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ ভারত চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৭৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার, সৌদি আরব ৭৫.৮ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য ৭১.৫ বিলিয়ন ডলার, জাপান ৫৭ বিলিয়ন ডলার, অস্ট্রেলিয়া ৫৫.৭ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্স ৫৫ বিলিয়ন ডলার, এবং ইউক্রেন ৫৩.৭ বিলিয়ন ডলার সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বরাদ্দ দিয়েছে।
ইরান, দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল ও আঞ্চলিক প্রক্সি গ্রুপে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভরতা অর্জন করছে। ২০২৫ সালে ইরানের আনুমানিক সামরিক বাজেট ২৪ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রকৃত ব্যয় আরও অনেক বেশি হতে পারে। তাছাড়া উচ্চাভিলাষী পরমাণু প্রকল্পে ইরানে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। পশ্চিমাদের দাবি অনুযায়ী, এ মুহূর্তে ইরানের হাতে ন্যূনতম ৬টি পরমাণু অস্ত্র তৈরি মতো যথেষ্ট ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে।
তুরস্ক ২০২৫ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় ঘোষণা করেছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। দেশটি নিজস্ব প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান (TF-X), ট্যাংক (Altay), ড্রোন এবং যুদ্ধজাহাজ তৈরির ওপর জোর দিচ্ছে। ন্যাটো সদস্য হয়েও তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ কেনার পর পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হয়, তবে তুরস্ক তার সামরিক উপস্থিতি পরিকল্পিতভাবে দক্ষিণ ককেশাস, লিবিয়া ও সিরিয়ায় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছে।
তবে মাত্র ৯১ লাখ জনসংখ্যার দেশ হলেও, ইস#রাইল কিন্তু চলতি ২০২৫ সালের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে। বিশেষ করে আইরন ডোম, অ্যারো-৩ ও ডেভিড স্লিং সিস্টেমের উন্নয়নে দেশটি বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই প্রকল্পগুলোর বড় একটি অংশে অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তি নিয়েও গবেষণায় বাড়তি ব্যয় করছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক চাপ, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য সংকট ও জ্বালানি ঘাটতির মতো সমস্যা মোকাবিলা করছে, তখন এত বিপুল সামরিক ব্যয় বিশ্বব্যাপী এক নতুন ধরনের নিরাপত্তা ও কৌশলগত উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। কূটনৈতিক আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ সংকুচিত হয়ে যুদ্ধ-সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকেও হবে ভয়াবহ।
এ পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও চরম উদ্বেগজনক। যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়লে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষা ও মানবাধিকার প্রশ্নে ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক সংলাপের পুনর্জাগরণ এবং সামরিক খরচ হ্রাস করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা। নতুবা বিশ্বকে এক অনিশ্চিত ও অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হতে পারে, যার দায়ভার কেবল বর্তমান প্রজন্ম নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও বহন করতে হবে।
তথ্যসূত্র: SIPRI, DW, Al Jazeera, The Guardian, CNN, Middle East Eye, Tehran Times, Global Firepower, Wikipedia.
-- বিজ্ঞাপন ---
পূর্ববর্তী সংবাদ
আমেরিকায় স্ত্রী ও সন্তানকে গুলি করে আত্মঘাতী ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.