-- বিজ্ঞাপন ---

মানবসভ্যতার জন্য হুমকি: পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা ও ভবিষ্যৎ

সিরাজুর রহমান#

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী যুদ্ধ ও অশান্তি থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে শক্তিধর ও প্রভাবশালী দেশগুলো নতুন করে পরমাণু অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইল শক্তি নিয়ে হাজির হয়। তাছাড়া বর্তমানে আধুনিক যুদ্ধকৌশলের অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কমব্যাট ড্রোন এবং নিজস্ব প্রযুক্তির ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল। সময়ের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক পরাশক্তি দেশ ব্যালিস্টিক মিসাইলের পরিসর, গতিবেগ, নিখুঁত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সক্ষমতা এবং পারমাণবিক বা প্রচলিত ওয়ারহেড বহনের সক্ষমতা অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
চলতি ২০২৫ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নিচে বিশ্বে ব্যালিস্টিক মিসাইল ও পরমাণু ওয়ারহেড শক্তিধর প্রথম সারির কিছু দেশের সামরিক সক্ষমতার একটি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ দেখা যায় যে, বিগত চার দশকে দেশগুলো তাদের প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরি খাতে ব্যয়, গবেষণা এবং উন্নয়ন ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। SIPRI (2025) অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ৯টি দেশের কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেডের আনুমানিক সংখ্যা হতে পারে ১২,১২৫টি। যদিও পৃথিবীর কোন দেশের কাছে কি পরিমাণ ব্যালেস্টিক মিসাইল কিংবা পরমাণু অস্ত্র মজুত রয়েছে তার বাস্তব অবস্থা জানার আপাতত কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সামরিক ও প্রতিরক্ষা গবেষণামূলক থিংক ট্যাংক এবং প্রতিষ্ঠানের দেয়া অনেকটাই আনুমানিক তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
কৌশলগত অস্ত্র সক্ষমতার দিক দিয়ে বর্তমানে রাশিয়া সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হয়। রাশিয়ার কাছে বর্তমানে স্ট্র্যাটেজিক ও ট্যাকটিক্যাল মিলে প্রায় ১,৬০০–২,০০০টি বা তারও অধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয় (SRBM থেকে শুরু করে ICBM পর্যন্ত)। রাশিয়া হাতে থাকা সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল হচ্ছে আরএস-২৮ সারমাত (শয়তান-২) ICBM মিসাইল। এর পাশাপাশি তাদের হাতে আরএস-২৪/২৬ এবং সাবমেরিন ভিত্তিক বুলাভা ব্যালেস্টিক মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে। তাছাড়া তাদের কাছে আনুমানিক ৫,৫৮০টি নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বিভিন্ন রেঞ্জ এবং সক্ষমতার ব্যালেস্টিক মিসাইলের আনুমানিক মজুতের দিক দিয়ে চীনের হাতে বর্তমানে প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ এর অধিক বিভিন্ন সিরিজের এবং রেঞ্জের কৌশলগত মিসাইল রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে Dongfeng (DF) সিরিজের SRBM, MRBM, IRBM এবং আধুনিক যুগের ICBM মিসাইল। এর পাশাপাশি চীনের পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা হতে পারে প্রায় ৫০০-৬০০ এর কাছাকাছি। বিশেষ করে চীন কখনোই তার কৌশলগত সামরিক সক্ষমতা নিয়ে বিশ্বের সামনে কোন তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে না।
এদিকে বিশ্বের প্রথম স্থানীয় সামরিক সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে প্রায় ৮০০ থেকে ১,২০০-এর মতো কৌশলগত ব্যালিস্টিক মিসাইল। যার মধ্যে Minuteman-III ICBM এবং সাবমেরিনে মোতায়েন থাকা Trident-II SLBM রয়েছে বিপুল পরিমাণে। তাছাড়া আমেরিকার মার্কিন নিউক্লিয়ার অ্যান্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের সংখ্যা হতে পারে আনুমানিক ৫,০৪৪টি।
আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারতের হাতে রয়েছে আনুমানিক ৫৫০টি কৌশলগত ব্যালিস্টিক মিসাইল। এর মধ্যে Agni সিরিজের মধ্য ও দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল উল্লেখযোগ্য। ভারতের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১৭৫টি। এদিকে পাকিস্তানের হাতে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৬০০টি কৌশলগত ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। তারা Shaheen, Ghauri ও Nasr সিরিজের ট্যাকটিক্যাল মিসাইল মোতায়েন করেছে এবং তাদের হাতের থাকা নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১৭০-এর মতো।
পরমাণু অস্ত্র নেই এমন দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি ও মজুত করেছে ইরান। বর্তমানে ইরানের রয়েছে বিশাল আকারের ব্যালিস্টিক মিসাইল ভাণ্ডার। ইরানের হাতে বিশাল মিসাইল ভাণ্ডার রয়েছে। যদিও কিছু অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী দেশটির হাতে আনুমানিক ২০,০০০টি পর্যন্ত SRBM ও MRBM মিসাইল মজুদ থাকতে পারে। তবে ইরানের SRBM ও MRBM-এর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০২০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (DIA) মতে, ইরানের হাতে ৩,০০০–৩,৫০০ মিসাইল থাকতে পারে। তাছাড়া দেশটি এখনো পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে ইন্টারনেটের একাধিক ওপেন সোর্সের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইসরাইলের হাতে আছে আনুমানিক ১৫০টি বা তার অধিক Jericho সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে। তবে দেশটি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্পর্কে কখনো প্রকাশ্যে কিছু বলে না। ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের কৌশলগত অস্ত্র ভান্ডারে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের সংখ্যা হতে পারে আনুমানিক ৯০টি।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে উত্তর কোরিয়া আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের অস্ত্র ভান্ডারে কৌশলগত অস্ত্রের তালিকা দেখলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচি বিশ্বজুড়ে দুশ্চিন্তার অন্যতম উৎস হয়ে রয়ে গেছে। উত্তর কোরিয়া প্রায় ৩০০ এর অধিক কৌশলগত মিসাইল তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়, যার মধ্যে SRBM, IRBM ও ICBM রয়েছে। দেশটির হাতে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড সংখ্যা আনুমানিক ৫০-এর মতো বলে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, এই মুহূর্তে বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রধারী ৯টি দেশের হাতে আনুমানিক ১২ হাজারেরও বেশি নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এবং কয়েক হাজার ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে। অধিকাংশ দেশের তাদের নিজস্ব কৌশলগত অস্ত্র নীতিমালায় স্বচ্ছ না থাকায় এক অনুমান ব্যতীত প্রকৃত সংখ্যা ও অবস্থা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন একটি কাজ হয়ে যায়। আসলে বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যত বেশি এইসব উচ্চ ধ্বংস ক্ষমতা সম্পন্ন অস্ত্রে বিনিয়োগ করছে, ততই বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ এইসব অস্ত্র যদি সংঘাতে ব্যবহার হয়, তাহলে তা হবে মানবসভ্যতার জন্য চরম বিপর্যয় এক পরিস্থিতি। তাই এই প্রবণতা ও অশুভ অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে বিশ্ববাসী এখন মুক্তি চায়।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.