-- বিজ্ঞাপন ---

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

‘অপারেশন সিঁদুর’: মধ্যরাতে পাকিস্তানে পাল্টা প্রত্যাঘাত, মৃত্যু ৮, উত্তপ্ত দুই প্রতিবেশী

নয়াদিল্লি/ইসলামাবাদ, ৭ মে:
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার জবাব দিতে একপ্রকার ‘মাপা কৌশলে’ মধ্যরাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানল ভারতীয় সেনা। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। পাকিস্তানের তরফে দাবি করা হয়েছে, এই অভিযানে অন্তত আট জন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং বহু আহত। ভারত সরকার এখনও নির্দিষ্ট শহরের নাম না জানালেও পাকিস্তান সরকারের তরফে একাধিক শহরের নাম ও ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ জানানো হয়েছে।

ছ’টি জায়গায় একযোগে ২৪টি হামলা
পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশনস্ (ISPR)-এর ডিরেক্টর জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহসান ইকবাল বুধবার ভোরে এক সাংবাদিক বৈঠকে জানান, মঙ্গলবার রাত ১টার পর পাকিস্তানের মোট ছ’টি স্থানে ২৪টি বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী।

বিভিন্ন শহরে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ—

বহাওয়ালপুরের আহমেদপুর পূর্ব:
শুভান মসজিদে চারটি স্ট্রাইকে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জন নিরীহ মানুষের। তাঁদের মধ্যে রয়েছে এক তিন বছরের শিশু। আহত ৩১ জন, যাঁদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ এবং ছয় জন মহিলা।

মুজাফফরাবাদ:
বিলাল মসজিদে সাতটি হামলায় এক জন আহত এবং মসজিদটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

কোটলি:
আব্বাত মসজিদে পাঁচটি হামলায় দুই জন নিহত, তাদের মধ্যে একজন ১৮ বছরের যুবক এবং অন্যজন ১৬ বছরের কিশোরী। এক মহিলা এবং তাঁর শিশু কন্যা আহত।

মুরিদকে:
উমালকুরা মসজিদে চারটি হামলায় এক জন নিহত, একজন আহত এবং দুই জন নিখোঁজ।

শিয়ালকোট ও শাকারগড়:
দুটি করে হামলা হলেও সেখানে হতাহতের কোনো খবর মেলেনি।

ISPR-এর ডিজি ভারতের এই হামলাকে “বিনাপ্ররোচনায় কাপুরুষোচিত” বলে কটাক্ষ করেন এবং জানান, “এটা একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা। পাকিস্তান এর উপযুক্ত জবাব দেবে।”

ভারতের প্রতিক্রিয়া: ‘পহেলগাঁও কাণ্ডের জবাব’
২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে আত্মঘাতী জঙ্গিহানায় নিহত হন ২৬ জন নিরীহ মানুষ। সেই ঘটনার পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেনাবাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেন এবং জানিয়ে দেন— “উপযুক্ত সময় ও স্থানেই জবাব দেওয়া হবে।”

মঙ্গলবার মধ্যরাতের পরে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানায়, “পাকিস্তানের ভিতরে ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তত ন’টি লক্ষ্যবস্তুতে সফল আঘাত হানা হয়েছে।” যদিও কোনো নির্দিষ্ট শহরের নাম জানানো হয়নি, সামাজিক মাধ্যমে বহাওয়ালপুর ও মুজাফফরাবাদের নাম উঠে এসেছে।

পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও হুঁশিয়ারি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ বুধবার সকালে এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এ লেখেন,

“পাকিস্তানের পাঁচটি এলাকায় কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়েছে শত্রু। পাকিস্তান এর যোগ্য জবাব দেবে। ইতিমধ্যেই তা শুরু হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানি সেনা জানে কিভাবে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হয়। দেশের সব নাগরিক তাদের পাশে আছে।”

সীমান্তে উত্তেজনা চরমে, সেনাবাহিনী সতর্ক
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ-রাজৌরি সীমান্তে পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতি চুক্তি ভেঙে কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। ভারতীয় সেনাও জবাব দিতে শুরু করেছে। বায়ুসেনার সমস্ত ইউনিটকে ‘হাই অ্যালার্টে’ রাখা হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।

রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিল্লি ও ইসলামাবাদে রাজনৈতিক মহলে চরম তৎপরতা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই হামলা ছিল প্রতিরোধমূলক ও সুনির্দিষ্ট, যাতে সন্ত্রাসবাদী পরিকাঠামো ধ্বংস করা হয়।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূত্রপাত নতুন নয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে জন্মলগ্ন থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীর। এ পর্যন্ত সংঘটিত প্রায় সব যুদ্ধ এবং বড় ধরনের সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু এই কাশ্মীর অঞ্চল।

🔺 ১৯৪৭-৪৮ সালের কাশ্মীর যুদ্ধ:
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি উপজাতি বাহিনী কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে এবং ভারত তার সেনাবাহিনী পাঠিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয় এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে বিভক্ত করা হয়। ভারতের নিয়ন্ত্রণে যায় জম্মু ও কাশ্মীর, আর পাকিস্তানের হাতে পড়ে আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চল।

🔺 কচ্ছ যুদ্ধ (১৯৬৫):
১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে কচ্ছ অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা পূর্ণাঙ্গ সামরিক রূপ নেয়। জুন মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং ১৯৬৮ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ে পাকিস্তান কিছু এলাকা লাভ করে।

🔺 কার্গিল যুদ্ধ (১৯৯৯):
১৯৯৯ সালের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধারা কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় ঢুকে পড়লে যুদ্ধ শুরু হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে আসা এই অনুপ্রবেশ ভারতের জন্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করে। ভারতীয় বাহিনী পাল্টা অভিযান চালায়। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক উদ্যোগে পাকিস্তান তাদের সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

🔺 পুলওয়ামা সংকট (২০১৯):
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক সেনা নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তান-ভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ভারত পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এ ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে আবার উত্তেজনা চরমে ওঠে।

🔺 সাম্প্রতিক উত্তেজনা:
২০২৫ সালের মে মাসে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল হামলা চালায়। পাকিস্তান একে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করেছে এবং পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। এখন দেখার বিষয়, দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার এই ধারা কতদূর গড়ায়। আন্তর্জাতিক মহলের তরফে শান্তি ও সংলাপের বার্তা আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।##

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.