-- বিজ্ঞাপন ---

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বিশ্বযুদ্ধের ছায়া

মধ্যপ্রাচ্য, পারমাণবিক হুমকি ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংকট

সিরাজুর রহমান#
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ ২০২৫ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় অর্ধশতাধিক বড় ধরনের যুদ্ধ, আঞ্চলিক সংঘাত এবং গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যেগুলোর ফলে হয়ত প্রায় ১০ কোটি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এই দীর্ঘ যুদ্ধকালীন সংকটের মধ্যে মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে এবং বিশ্বশান্তির পথে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। অথচ প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে কিংবা উস্কানীতে আজও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং আঞ্চলিক সংঘাতের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে।

বিশেষ করে অতি সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে গভীর শত্রুতা এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি চলমান রয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইসরাইলের নিরাপত্তার উদ্বেগ মধ্যপ্রাচ্যের এই দীর্ঘ মেয়াদি সংঘাতকে আরো জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, এই আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বৈশ্বিক পরাশক্তিরাও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে, যা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত ও অনিশ্চিয়তার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া গত ২০২৪ সাল থেকে গাজায় মানবিক বিপর্যয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে । গাজা সংকট, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলা এবং ইরান ও তুরস্কের সিরিয়া ভিত্তিক অভিযান সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে এক অগ্নিগর্ভে পরিণত করেছে। এদিকে ইরান ও ইসরাইল একে অপরের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সরাসরি কমব্যাট ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে ভয়ংকর ও প্রাণঘাতী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এই যুদ্ধ যদি আরও বিস্তৃত হয়, তাহলে এর পরিণতি গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং সারা বিশ্বেই এর বিরুপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।
এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষ অবলম্বন করছে, অপরদিকে চীন ও রাশিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইরানের কৌশলগত অবস্থানকে বৈধতা দিচ্ছে। এই ভূরাজনৈতিক বিভাজন আসলে ২১শ শতকের এক নতুন “কোল্ড ওয়ার” পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করছে। বর্তমানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে রয়েছে। যার ফলে যুদ্ধাপরাধ, মানবিক বিপর্যয় ও শরণার্থী সংকট দ্রুত বাড়ছে এবং তা আশাঙ্কাজনক হারে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।
গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা, অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আবারও ভয়ংকর দিকে মোড় নিয়েছে। পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের “নো ফার্স্ট ইউজ” নীতির পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কঠোর বক্তব্য ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি যুদ্ধের আশঙ্কাকে আরো তীব্র করে তুলেছে। এদিকে রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনে তার অত্যাধুনিক “ওরেশনিক” ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে (যদিও নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ছাড়াই), যা যুদ্ধক্ষেত্রে ICBM ব্যবহারের প্রথম নজির হিসেবে পরিগণিত হয়। এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর এক ভয়ংকর বার্তা বহন করে।
এদিকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে রাশিয়া একাধিকবার সরাসরি কিংবা আকার-ইঙ্গিতে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধে চলমান ব্যর্থতা এবং পশ্চিমাদের কৌশলগত সহযোগিতা রাশিয়াকে কিছুটা চাপে ফেলেছে। যার ফলে মস্কো মাঝে মধ্যেই কৌশলগত কারণেই “নিউক্লিয়ার অপশন” তোলার চেষ্টা করছে। আবার চীন ও উত্তর কোরিয়া প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চালাচ্ছে, যার ফলে সমগ্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে গভীর উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বিশ্বের সামরিক পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়েছে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে। রাশিয়া ও অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো সময়-সময় বিভিন্ন অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি উচ্চারণ করেছে, যা আসলে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য এক ভীতিজনক সংকেত হিসেবে দেখা দেখা হয়। পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকায়ন ও নিউক স্টকপাইলিং বেড়ে যাওয়ায় আগামীর যুদ্ধ কেবল প্রচলিত অস্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং এসব অপ্রচলিত প্রাণঘাতী অস্ত্র আগামীতে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তাই এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব অনেক কঠোর ও জরুরি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, সামরিক প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ যুদ্ধে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বর্তমানে এআই প্রযুক্তি নির্ভর কমব্যাট ড্রোন, লেজার ওয়েপন্স, সুইসাইডাল ড্রোন, হাইপারসনিক মিসাইলসহ নতুন প্রজন্মের অস্ত্রগুলো যুদ্ধের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব প্রযুক্তি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় বর্তমানে প্রচলিত যুদ্ধের ধারণাকেই আমূলে বদলে দিয়েছে। এতে ছোট দল বা দেশও উচ্চ প্রযুক্তির হামলা চালাতে সক্ষম হচ্ছে। উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর ড্রোন এবং অটোনোমাস কিলার রোবটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীন হলে এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি ও হুমকী সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক স্বল্প আয়ের ও উন্নয়নশীল দেশও প্রতিরক্ষা খাতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যয় বাড়াচ্ছে। যার বিরুপ প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রপ্তানিতে পাঁচটি প্রধান দেশ যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি—একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে। এই পাঁচ দেশই সমগ্র বিশ্বের প্রায় ৭৫% অস্ত্র সরবরাহ করে। তবে সবচেয়ে আসাঙ্খার বিষয় হলো যে, সসারা বিশ্বের এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বাণিজ্যের আনুমানিক ৪০% থেকে ৪৫% পর্যন্ত সরাসরি চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা আমির শাসিত আরব দেশগুলোতে।
অতি সম্প্রতি চীনের পরীক্ষিত নন-নিউক্লিয়ার হাইড্রোজেন বোমা নতুন বিশ্বক এক নতুন বাস্তবতা সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। নন-নিউক্লিয়ার এই প্রযুক্তি পরমাণু পদার্থ ছাড়াই অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। যদিও এটিকে এখন পারমাণবিক বোমার বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু এর কৌশলগত ব্যবহারও মানবজাতির জন্য ভয়াবহ হতে পারে। এটি একটি দ্বিমুখী প্রযুক্তি—মানব কল্যাণে ব্যবহার হলে বিপ্লব, অস্ত্রায়নে গেলে মহাবিপদ।
বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একতা, সংলাপ ও মানবিক চিন্তাভাবনা। সব দেশকেই উচিত পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি (CTBT, NPT) মানা, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার বদলে টেকসই উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। যদি আমরা সবাই মিলে সংঘাত নয়, শান্তিকে অগ্রাধিকার দিই—তবেই সম্ভব হবে বিশ্বকে এক মানবিক, নিরাপদ ও উন্নয়নমুখী সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা। নয়তো চলমান যুদ্ধ, প্রভাব বিস্তারের অশুভ প্রতিযোগিতা এবং যুদ্ধ প্রযুক্তির এই উন্মাদনা একদিন আমাদের মানবজাতির অস্তিত্বই হয়ত ধ্বংস করে ফেলবে।#

তথ্যসূত্র:

(১) বিশ্বযুদ্ধ ও আধুনিক সংঘাত পরিসংখ্যান – ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার ডেটাবেস
(২) সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট (২০২৫) – ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্ব
(৩) বুলেটিন অফ দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস (২০২৫) – পারমাণবু অস্ত্রের হুমকি ও আধুনিকায়ন
(৪) স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) রিপোর্ট (২০২৫) – বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র বাণিজ্য

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.