-- বিজ্ঞাপন ---

মধ্যপ্রাচ্যের দাবার ছকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: হিজবুল্লাহ ও হুথিরাও সক্রিয়

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের শেষ কোখায়-২

কাজী আবুল মনসুর#

মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি আর গোয়েন্দা যুদ্ধ মানেই — একবার ঢুকলে বেরোনো মুশকিল। এটা যেন এক বিশাল দাবার খেলা, যেখানে প্রতিটি চালের পেছনে থাকে বছরের পর বছর পরিকল্পনা, বিশ্বাসঘাতকতা আর কৌশল। সবার প্রশ্ন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? ইরানের সুবিধা হচ্ছে, ইরান ইসরাইলের চেয়ে ৭৫ গুন বড়। আয়তন ১.৬৫ মিলিয়ন বর্গকিমি (আফগানিস্তানের চেয়ে বড়) ।আর ইসরাইল হচ্ছে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের সমান একটি দেশ। আয়তন মাত্র ২২,১৪৫ বর্গ কিলোমিটার। যদি ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি একসাথে আঘাত হানে, তবে ইসরায়েলের সামনে এটি হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু — ইসরায়েলও বসে থাকবে না। তারা প্রতিটি ফ্রন্টে পাল্টা আগুন দেবে, হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ও কমান্ড ধ্বংসে কাজ করবে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটকে পাশে টানবে। একই সাথে ইরানের ভেতরে থাকা মোসাদকে আরও ধংসাত্মকভাবে কাজ লাগাবে।
যুদ্ধ যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে ইসরায়েলেও ধংস কম হয়নি। কিন্ত প্রাণহানি কম । এর কারণ ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে নতুন প্রতিটি বাড়িতে বা অ্যাপার্টমেন্টে “মামাদ” (MAMAD) নামে পরিচিত একটি নিরাপত্তা কক্ষ থাকা আইনগত বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। মামাদ মানে: “Merhav Mugan Dirati” (Residential Protected Space) — এটি হলো বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময়ের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এক কক্ষ।বিশেষভাবে সজ্জিত কংক্রিট ও ইস্পাত দিয়ে তৈরি।গ্যাস ও রাসায়নিক প্রতিরোধী দরজা ও জানালা,ঘরের অন্যান্য অংশের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত, অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ, পানি ও বাতাস ফিল্টার সিস্টেম। এটি সাধারণ সময়ে স্টোররুম, বাচ্চাদের রুম বা অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ইসরাইলে যখন সাইরেন বাজে মানুষ ২০ থেকে ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে ওই রুমে ঢুকে পড়ে, কারণ ক্ষেপণাস্ত্র খুব দ্রুত পৌঁছায়। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলে (গাজা সীমান্তে) যেমন আশকেলন, বিয়ারশেভা, সেখানে প্রায় প্রতিদিন এই নিরাপত্তা কক্ষগুলো কাজে লাগে। ইসরায়েলের প্রধান ‘ওয়ার রুম’ – “বোর” (The Bor) “The Bor” (হিব্রুতে “গহ্বর”) — এটি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি গভীর ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, তেল আবিবে অবস্থিত। এটি প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান হাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বাঙ্কারেই জরুরি জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠক হয় (বিশেষত গাজা, ইরান, হিজবুল্লাহ সংক্রান্ত)। বর্তমানে বাঙ্কারে বসেই ইরানের সাথে যুদ্ধ মোকাবেলা করছে ইসরাইল।
এদিকে এরই মধ্যে ইরান হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন দেশে থাকা ইরান সমর্থিত বাহিনীগুলোকে পুরোদমে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। হিজবুল্লাহর কমান্ডোদের মাধ্যমে লেবাননের দিক থেকে প্রতিদিন রকেট, ড্রোন ও অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনা ও শহর লক্ষ্য করে হামলা হচ্ছে। ইসরায়েলও পাল্টা লেবাননে হামলা চালাচ্ছে। ইয়েমেন থেকে হুথিদের মাধ্যমে আঘাত হানা হচ্ছে। হুথি বিদ্রোহীরা ইরান-সমর্থিত। তারা ইসরায়েলের বন্দর ও জাহাজ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক শিপিং বিপর্যস্ত। ইরান ইসরায়েলের পানি সরবরাহ, ট্রাফিক সিস্টেম, ব্যাংক ও হাসপাতাল লক্ষ্য করে সাইবার হামলা চালাচ্ছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট ও মোবাইল নেটওয়ার্কে বিঘ্ন ঘটে। ইরানের IRGC (Revolutionary Guard) ও তাদের নিয়ন্ত্রিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী ইরাক ও সিরিয়া থেকে ড্রোন ছুঁড়ছে।ইসরায়েলি ঘাঁটি ও সেনা লক্ষ্য করে হামলা চলছে। ইরান মূলতঃ হিজবুল্লাহকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজায়। ইরান হিজবুল্লাহকে বছরে প্রায় ৭০০–১০০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি দেয়।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে ইরানপন্থী শিয়া গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে “হিজবুল্লাহ” (Hezbollah = Party of God) নামে সংগঠিত হয়। ১৯৮৫ সালে তারা প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে “উদ্দেশ্যপত্র” (Manifesto) প্রকাশ করে। হিজবুল্লাহর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল:ইসরায়েলি বাহিনীকে লেবানন থেকে বিতাড়িত করা, ইরান ভিত্তিক ইসলামি সরকার কায়েমের চিন্তা,আমেরিকা ও ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলা,শিয়া জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হিজবুল্লাহ কেবল অস্ত্রের সংগঠন নয়। তারা দুই পথে এগোয়: গেরিলা যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী হামলা (বিশেষ করে ১৯৮৩ সালের বৈরুত মার্কিন ও ফরাসি সেনা ঘাঁটিতে আত্মঘাতী হামলা ছিল বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী), স্কুল, হাসপাতাল, সামাজিক সেবা চালু করে জনগণের আস্থা অর্জন — লেবাননের দরিদ্র শিয়া জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে দমাতে পারল না, বরং প্রতিটি হামলা তাদের আরও জনপ্রিয় করে তোলে। ২০০০ সালে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে পিছু হটে — হিজবুল্লাহ এটিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। হিজবুল্লাহকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী “প্রক্সি শক্তি” বলা হয়।
হিজবুল্লাহর উত্থানের পর (মূলত ১৯৮৫ থেকে শুরু করে), লেবাননসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক রাজনৈতিক সংকট, সহিংস সংঘর্ষ, এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হিজবুল্লাহ কেবল একটি “মিলিশিয়া” ছিল না — বরং একটি শক্তিশালী আদর্শিক, সামরিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যার প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষ ছিল ইসরায়েল এবং পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা। ১৯৮৩ থেকে ৮৫ সালে মার্কিন ও পশ্চিমা উপস্থিতির ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়
হিজবুল্লাহ-ঘনিষ্ঠ সংগঠনরা । ১৯৮৩ সালে বৈরুতে মার্কিন ও ফরাসি সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী ট্রাক বোমা হামলা চালায়। ২৪১ জন মার্কিন ও নৌসেনা প্রাণ হারায়। সাথে ৫৮ জন ফরাসি সেনাও।এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী আত্মঘাতী হামলাগুলোর একটি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র লেবানন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়।
হিজবুল্লাহ তখন থেকেই নিজেদের ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
অতীতের ইতিহাস বলছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি একযোগে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালানো শুরু করবে।
হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে কয়েক হাজার রকেট ছুড়বে,হামাস গাজা সীমান্ত দিয়ে ড্রোন ও টানেলের মাধ্যমে ঢুকে পড়ে,হুথি ও ইরান ড্রোন/ক্রুজ মিসাইল দিয়ে মূল লক্ষ্যগুলোতে আঘাত করবে। তেলআবিব, হাইফা, আশকেলনসহ বড় শহরগুলোয় প্যানিক ও ব্ল্যাকআউট পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যা হতে শুরু করেছে।
ইসরায়েল জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবে। বসে থাকবে না ইসরাইলও। আইডিএফ (Israeli Defense Forces) সিরিয়া, লেবানন ও গাজার ওপরে ব্যাপক বিমান হামলা চালাবে। আয়রন ডোম দিয়ে প্রতিরক্ষা করা হলেও,ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইসরায়েল গাজা ও দক্ষিণ লেবাননে গ্রাউন্ড ট্রুপ পাঠানোর পরিকল্পনা নেবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে “পূর্ণ সমর্থন” জানাবে। আরব বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত হয় — কেউ ইরানের পক্ষে, কেউ নিরপেক্ষ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়বে, জাতিসংঘ মানবিক করিডোর খোলার আহ্বান জানাবে।
যুদ্ধ এখন আর শুধু ইসরায়েল বনাম ইরান বা হিজবুল্লাহ নয় — এটি এক আঞ্চলিক সংঘর্ষে রূপ নিতে যাচ্ছে। ইসরায়েল হয়তো প্রতিপক্ষকে সাময়িকভাবে ঠেকাতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধ থামানো কঠিন হয়ে পড়বে।বিশ্বব্যাপী এর অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে।##

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.