-- বিজ্ঞাপন ---

চীনের মার্চেন্ট শিপিংয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি: বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

সিরাজুর রহমান#

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার চীনের মার্চেন্ট শিপিং ইন্ডাস্ট্রির ওপর কঠোর শুল্কনীতি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর মূল লক্ষ্য হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীনের একতরফা আধিপত্য রোধ করা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, চলতি ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে বৈশ্বিক সমুদ্রপথ পরিবহণ ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে, যার বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বের পণ্য রপ্তানি ও আমদানি খাতে পড়বে।

নতুন এই শুল্কনীতির আওতায়, চীনা জাহাজের মাধ্যমে আমদানি করা প্রতিটি টন পণ্যের ওপর ৫০ ডলার হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা প্রতি বছর ৩০ ডলার করে বৃদ্ধি পেয়ে তিন বছরের মধ্যে যথাক্রমে ৮০ ডলার হবে। পাশাপাশি, নন-চাইনিজ কোম্পানিগুলো যদি চীনা জাহাজ ব্যবহার করে মার্কিন সমুদ্রবন্দরগুলোতে পণ্য আনে, তাদেরকেও অতিরিক্ত ১৮ ডলার প্রতি টন শুল্ক দিতে হবে। গাড়ি পরিবহনকারী Ro-Ro জাহাজের প্রতিটি গাড়ির জন্য ১৫০ ডলার অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব শুধু চীন নয়, বরং গোটা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এবং অর্থনীতির ওপর পড়বে। বর্তমানে বিশ্বের আনুমানিক ১৫% থেকে ২০% সমুদ্রপথ পণ্য ও পরিষেবা পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের হাতে, যেখানে চীনের বাণিজ্যিক নৌবহর (মার্চেন্ট ফ্লিট) একটি প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

বর্তমানে চীনের বাণিজ্যিক নৌবহরের আকার প্রায় ১,১৮,৩০০টি জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে:

ওশান-গোয়িং জাহাজ: ৯৭২টি

তেলবাহী ট্যাংকার: ৬,০৫৭টি

বাল্ক ক্যারিয়ার: ১৩,৩৪০টি

সাধারণ কার্গো জাহাজ: ৬,০৫৭টি

কন্টেইনারবাহী জাহাজ: ২,৯৬৮টি

চীনের বর্তমান বাণিজ্যিক মেরিন এসেট ভ্যালু (জাহাজ মালিকানা মূল্য) প্রায় ২৭০ বিলিয়ন থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, গ্লোবাল মার্চেন্ট ফ্লিটের প্রায় ১০% এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং বিশ্বের ৫০% শিপবিল্ডিং ক্যাপাসিটি এখন চীনের হাতে। নতুন জাহাজের ৬০% অর্ডার চীনা জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। এর অর্থ, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব বাণিজ্য কার্যত চীনের শিপিং অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। অন্তত আগামী এক দশক পর্যন্ত চীনের বিকল্প কোনো বড় উৎস তৈরি হওয়া কঠিন।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক জাহাজ বহর তুলনামূলকভাবে দুর্বল। যদিও ছোট-বড় মিলিয়ে মোট মার্কিন মার্চেন্ট ভেসেলের সংখ্যা ৪০,০০০-এর বেশি, তবে গভীর সমুদ্রগামী বড় বাণিজ্যিক কার্গো জাহাজের সংখ্যা মাত্র ১৮০–১৯০টি। এছাড়া মার্কিন পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা দেশের বাইরে মিলিয়ে প্রায় ১,০০০-এর কাছাকাছি হলেও, গ্লোবাল মার্চেন্ট শিপিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ০.৫% এরও কম।

এক্ষেত্রে, চীনের শিপিং শক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতায় একটি বড় ব্যবধান রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যুক্তরাষ্ট্র, এখন মার্চেন্ট শিপিং সেক্টরে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এভাবে, আমেরিকা এখনো পর্যন্ত নিজেকে গ্লোবাল মার্চেন্ট শিপিং সেক্টরে ৫% নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।

ভারতের মার্চেন্ট শিপ ফ্লিটের আকার ১,৫০০টির বেশি (বিশ্ব ফ্লিটের ১%-এরও কম), আর রাশিয়ার মার্চেন্ট শিপ ফ্লিটের আকার ২,০০০–২,২০০টি (বিশ্বের প্রায় ১.২%–১.৫%)। এই দুই দেশের শিপিং ফ্লিটের আকার এবং তাদের কার্যক্রমের তুলনামূলকভাবে সীমিত হলেও, ভবিষ্যতে চীনের বিকল্প হিসেবে এগুলোকে দ্রুত গড়ে তোলা কঠিন হবে।

এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র কি একাই চীনের শিপিং শক্তির ওপর চাপ প্রয়োগ করে বৈশ্বিক বাণিজ্যে আধিপত্য কায়েম করতে পারবে? বাস্তবতা হলো, তা সম্ভব নয়। বরং, এই ধরনের কঠোর শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নিজের সার্বিক অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

যদি চীনা জাহাজ পরিহার করে ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া বা তুরস্কের মতো দেশের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়, তবুও চীনের বিকল্প হিসেবে সমপর্যায়ের সক্ষমতা অর্জন করা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হবে না। শিপবিল্ডিং শিল্পে নতুন বিনিয়োগের পরও, এর ফল পেতে কমপক্ষে এক দশক সময় লাগবে।
অতিরিক্ত খরচের কারণে বহু দেশ হয়তো মার্কিন বন্দর ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারে, ফলে আমেরিকান বন্দরগুলোর রাজস্ব আয় হ্রাস পাবে। একইসঙ্গে, বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
চীনের শিপিং এবং সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে এত গভীর সংযুক্তির কারণে, চীনের বিকল্প তৈরি এখনই সম্ভব নয়। তাই শুধু চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করলেও তার নেতিবাচক অভিঘাত গোটা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পড়বে, এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এর প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন আরও বাস্তববাদী, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি।##তথ্যসূত্র: সংগৃহীত উপাত্ত এবং লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ।##

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.