-- বিজ্ঞাপন ---

কি শেখায় আমেরিকার প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাদের?

সিরাজুর রহমান#

শিক্ষা একটি জাতির সভ্যতা, উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ গঠনের ভিত্তি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে একটি গবেষণা-নির্ভর, শিশু-কেন্দ্রিক ও প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তাই এই আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশের জন্য হতে পারে একটি অনুকরণীয় মডেল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিশুদের শেখার প্রক্রিয়া কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, ভাষাগত ও বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতা বিকাশের ওপর জোর দেয়। এই কাঠামো তৈরি হয়েছে Harvard Graduate School of Education, Stanford University, এবং National Institute for Early Education Research (NIEER)-এর মতো প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ভিত্তিতে।
এখানে প্রাথমিক শিক্ষা সাধারণত কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ৫ বছর বয়সে শুরু করে ১০ বা ১১ বছর বয়সে শেষ করে। এই পর্যায়টি পড়া, লেখা এবং গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক দক্ষতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
আমেরিকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিশুদের শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়, বরং উদ্দীপক প্রশ্ন, পর্যবেক্ষণ, ও খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, “পাতা কেন ঝরে পড়ে?”—এমন প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করে। এতে শিশুদের সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধানী মনোভাব গড়ে ওঠে। পাঠদান হয় প্রকল্পভিত্তিক কাজ, গল্প বলা, দলগত আলোচনা, ও আনন্দময় পদ্ধতিতে।
মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়:
আমেরিকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষার পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। শিক্ষকরা শিশুদের শ্রেণিকাজ, আচরণ, অংশগ্রহণ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করেন এবং বিভিন্ন ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট টুল ব্যবহার করে তা নথিভুক্ত করেন।
বছরে দুই থেকে তিনবার অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতির বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। এতে অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ পড়ে না এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।
শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য স্নাতক পাশের পর Teacher Preparation Program কোর্স সম্পন্ন করতে হয় এবং চাকুরী লাভের পূর্বেই আগ্রহী প্রার্থীকে রাজ্য-অনুমোদিত লাইসেন্স অর্জন করা আবশ্যক। আবার শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পর থেকেই পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও পেশাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়।
দেশটির প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে থাকে ছবি, চার্ট, বুকশেলফ, কম্পিউটার, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, SRM, ইন্টার‌্যাকটিভ বোর্ড ইত্যাদি। প্রত্যেক শিশুর জন্য থাকে পৃথক ডেস্ক। STEM (Science, Technology, Engineering, Math) শিক্ষা কার্যক্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে শিশুরা গবেষণামুখী ও সমস্যা-সমাধানভিত্তিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।
শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা!
যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্মানজনক বেতন এবং পেশাগত সুবিধা ভোগ করেন। গত ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী, শিক্ষকদের গড় বার্ষিক বেতন প্রায় $৬০,০০০ – $৭৫,০০০ (অঞ্চল ও অভিজ্ঞতা অনুসারে ভিন্ন হতে পারে) হতে পারে। এর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা হিসেবে স্বাস্থ্য বীমা, পেনশন, মাতৃত্ব/পিতৃত্বকালীন ছুটি, প্রশিক্ষণ ভাতা, গৃহঋণ সুবিধা এবং কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে বেতন বৃদ্ধির সুযোগ ও পুরস্কার পেয়ে থাকেন।
তাই পরিশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাভিত্তিক, শিশু-কেন্দ্রিক ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশের জন্য পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও, এর অনেক দিক আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য হতে পারে। বড় বাজেট বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি না থাকলেও, একজন যত্নবান, মানবিক ও সৃজনশীল শিক্ষক তার শ্রেণিকক্ষে শিশুদের কৌতূহল, আত্মবিশ্বাস ও শেখার আনন্দ জাগিয়ে তুলতে পারেন। কারণ, আজকের শিশুরাই হবে আগামী দিনের আধুনিক, দক্ষ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নির্মাতা।##

1. Graduate School of Education (HGSE)
2. National Institute for Early Education Research (NIEER)
3. U.S. Bureau of Labor Statistics (BLS)

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.