কাজী আবুল মনসুর#
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও এখনও পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ যে অর্থ পাওনা রয়েছে, তা আজও পরিশোধ হয়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করে। সময়ের পরিক্রমায় সেই অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯.৫ লক্ষ কোটি টাকা! ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়। তবু পাকিস্তান আজও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক মানদণ্ড অনুযায়ী বার্ষিক ৬ শতাংশ সুদে ১৯৭৪ সালের এই দাবি ২০২৫ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ৭৮.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২২ টাকা ধরে হিসাব করলে, এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯৫,২৮৩৭ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯.৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই পাওনা ১৯৭৪ সালেই জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার স্পষ্টভাবে দাবি করে যে, পাকিস্তানের যৌথ সম্পদের অংশ হিসেবে এই অর্থ পাওনা।
তবে শুধু অর্থনৈতিক পাওনা নয়, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের আরও রয়েছে নানা ধরনের দাবি—যেমন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার, যুদ্ধবন্দীদের বিচারিক প্রক্রিয়া, পাকিস্তানে রেখে দেওয়া সম্পত্তির ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাকিস্তানের কাছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পুনরুদ্ধার সম্ভব না হলেও, বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা উচিত। এতে করে ইতিহাস যেমন স্মরণে থাকবে, তেমনি নতুন প্রজন্মও সঠিক তথ্য সম্পর্কে সচেতন হবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে তৎকালীন অখণ্ড পাকিস্তানের সম্পদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল ৪.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ধেক—অর্থাৎ ২১৬ কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় গোর্কির পর আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারও পাকিস্তান নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত তিনটি প্রধান দাবি হলো—
১. ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা,
২. যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণ প্রদান,
৩. বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়া।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বারবার এ তিনটি বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। তবে এখনো পর্যন্ত পাকিস্তান কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় গোর্কিতে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাপী মানবিক সহানুভূতি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিদেশি সাহায্য আসে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু এসব অর্থ তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকার শাখা থেকে লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়। পাকিস্তান পরবর্তীতে এসব অর্থ ফেরত দেয়নি। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এ অর্থ ফেরতের দাবি জানিয়ে আসছে।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছেন এ কারণে যে, স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশকে সম্পদের অংশ দিতে বাধ্য হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সব সম্পদ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের কোন জাহাজ ও বিমান পর্যন্ত রেখে যায়নি। তাদের উচিত দ্রুত স্বীকৃতি ও আমাদের প্রাপ্য সম্পদ ফেরত দেওয়া। আমি আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায়সংগত প্রাপ্য ছাড়া পাকিস্তানের কাছ থেকে আর কিছুই চাই না।”
কূটনৈতিক টানাপোড়েনের বাদবাকি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশ কিছুদিন এই বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকে। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভের পর পাওনা আদায় নিয়ে বাংলাদেশ তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল দিল্লীতে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের দু’দিন আগে বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা “দৈনিক বাংলা” প্রাপ্য বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলা হয়- শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা তখনকার মূল্যমানে ৫০০০ (পাঁচ হাজার) কোটি টাকা। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সহায়তার জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আসে। ঢাকা স্টেট ব্যাংকে থাকা এই টাকা যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তান সরকার পুরোটাই স্টেট ব্যাংক অফ লাহোরে পাচার করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে পুনর্বাসন কার্যক্রমে জড়িত জাতিসংঘের UNROD এর হিসাবে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশের সরকারী হিসাবে ১২৪৯ (এক হাজার দুইশ ঊনপঞ্চাশ) কোটি টাকা।
দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও তৎপর হয়ে উঠে। উর্দূ পত্রিকা “নওয়া-ই-ওয়াক্ত” ১৯৭৪ সালের ১৯ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, শুধু বিহারীদের বাংলাদেশে ৫৫০০ কোটি রুপি সম্পদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানকে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া। এই প্রতিবেদনের হিসাব থেকে বুঝতে কঠিন হয় না যে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকার বিপরীতে ৫৫০০ কোটি রুপির পাল্টা দাবির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সম্পদ দাবির ভিত্তিকে দূর্বল করা।
ঐ বছরের জুন মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন প্রাপ্য সম্পদের একটি দালিলিক হিসাব প্রস্তুত করে। এতে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে কোন খাতে বাংলাদেশের প্রাপ্য কতো তা উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের সম্পদের হিসাবও দেখানো হয়। একই সাথে অখন্ড পাকিস্তানের অংশ থাকাকালীন বৈদেশিক ঋণের কতটুকু বাংলাদেশের দায় তাও উল্লেখ করা হয়। এসময় দু’জন বিদেশী বিশেষজ্ঞ তাঁদের গবেষণায় দেখান, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক হিসাব বাদ দিলেও পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৩৯৭৫ মিলিয়ন ডলার।
১৯৭৪ সালের জুনের শেষদিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল দেয়া হয়, তাতে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত ছিল। বৈঠকে বাংলাদেশ স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ১১,০০০,০০০ ডলারসহ মোট ৪০০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ দাবি করে। বিপরীতে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান ১০.৮৮ কোটি টাকা পাবে। সফরসঙ্গী ১০০ জনের মধ্যে কোনো অর্থ বিশেষজ্ঞ নেই দাবী করে ভুট্টো এই আলোচনা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও বাংলাদেশের চাপে পাকিস্তান এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কমিটি গঠনে রাজি হয়। তবে পাকিস্তান এ কথাও জানিয়ে দেয় যে নীতিগতভাবে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণে প্রস্তুত নয়।
ভুট্টো ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা এলেও সফরের ব্যর্থতার বিষয়টি আড়াল করতে দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের দাবির সমালোচনায় মুখর হন। অন্যদিকে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে পূর্বশর্ত হিসেবে সম্পদ বণ্টন ও অবাঙালি প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ ইস্যুটির অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর লন্ডনে হিথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতি অমীমাংসিত সমস্যাবলির সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা আমাদের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আমরা তো কারও কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি না।”
১৯৭৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই সম্পদের পাওনা আদায়সহ অন্য দাবিগুলো নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এ দাবিগুলো আর তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। ১৯৭৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জ্যামাইকার রাজধানী কিংসটনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের বৈঠকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটির সমাধানে আলাদাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলমন্ত্রী ওতেইবা ১৮ জুন ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তান সফর করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেদ্দায় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরেই বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এমন একটি ধারণাও দেন। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে যে কোন একটি দেশের মধ্যস্থতা কামনা করে। ওআইসি সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আসন্ন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আবারও আলোচনা হবে।
১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ এক সরকারি ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে খুশি হয়, কারণ বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই ছিল তাদের মালিকানাধীন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও সরকার ১৯৭৮ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে থাকে। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সরকারের এক আদেশে পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দাবি করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের সুযোগ পান। বহু অবাঙালি মালিক এ সুযোগে ঢাকা এসে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, নন অপশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি বের করে নিজেরাই রিটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পত্তি ফিরে পাওয়া অবাঙালি ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা পাকিস্তান বা অন্যত্র পাচার করে। পাশাপাশি পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।
১৯৮১ সালে জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়। তবু পাকিস্তান আজও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ একাত্তরকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হিসেবে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন। পরে ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এসে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করলেও গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি। তবে একই বছরে পাকিস্তানের ৫১টি নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ বিলম্বিত হওয়ার সমালোচনা করে।
২০০৬ সালে ইউএনএইচসিআরের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তখনও প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার পাকিস্তানি আটকে ছিলেন। সেই সময় সৌদি আরবভিত্তিক জামাতুদ-দাওয়ার অর্থায়নে পাকিস্তান সরকার একটি আবাসন প্রকল্প শুরু করেছিল আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে। পাঞ্জাব প্রদেশে ১০ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে ৫ হাজার আবাসিক ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে প্রকল্পও থেমে যায়। পাকিস্তানের অনেক অঞ্চল থেকে এই প্রত্যাবাসনের বিরোধিতাও উঠে আসে। ২০০৪ সালে লাহোর হাইকোর্ট ঘোষণা দেয় যে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের নাগরিক, ফলে এই ইস্যু আরও জটিল হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জিয়া এম ইস্পাহানির কাছে এ তিনটি দাবি তুলে ধরেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ২০১০ সালে ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকেও একই দাবি পুনরায় তোলা হয়। ২০১১ সালে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহদি হাশমি কুরেশির কাছেও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। এরপর ২০১২ সালে ঢাকায় সফরে আসা পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার বাংলাদেশের দাবিগুলো শুনে বলেন, “একাত্তরের ঘটনাগুলো ভুলে যেতে হবে।” এরপর থেকে আর কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়নি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের আগষ্টে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। এর এক মাসের মাথায় গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইনে দু’জনের মধ্যে বৈঠক হয়, সেখান থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের জট খোলার ইঙ্গিত আসে। ঢাকা ও ইসলামাবাদের উভয় দেশের কূটনীতিকরাও আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এরই অংশ হিসেবে ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ বাংলাদেশে আসেন। এদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মো. জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ তাঁর দেশের নেতৃত্ব দেন। প্রায় ১৫ বছরের বিরতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নিতে আমনা বালুচ ঢাকায় আসেন। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর আমনা বালুচ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি। এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন এবং অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর।’ এখন শুধু দেখার অপেক্ষা, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কি ফলাফল আসে।##
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি/Preset71/পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ/ Just Faaland J.R. Parkinson, Bangladesh The Test Case of Development, London: C. Hurst and Company, 1976/ New York Times, 9 July 1974/ বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একটি অপ্রকাশিত হিসাব, মতিউর রহমান, সাপ্তাহিক সন্ধানী#
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.