ইসরাইলি বোমা কেড়ে নিলো সাহসি ফটো সাংবাদিক ফাতিমা হাসসুনার জীবন
একই সাথে নিহত গর্ভবতী বোনসহ পরিবারের আরও ১০ সদস্য
মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই ফতিমা সমাজমাধ্যমে একটি লেখা পোস্ট করেছিলেন। সেখানে তিনি লেখেন,‘‘আমার যদি মৃত্যু হয়, তা যেন শুধু ব্রেকিং নিউজ়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। অথবা মৃতের তালিকায় নিছকই একটি সংখ্যা হয়ে না থাকে। আমি এমন মৃত্যু চাই যা গোটা বিশ্ব দেখবে। গোটা বিশ্বে যার প্রভাব পড়বে। যা শুধু সময় আর স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।’’
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বুধবার তাঁর সেই ‘ইচ্ছাপূরণ’ হয়েছে। ইজ়রায়েলি বিমান হামলায় উত্তর গাজ়ায় নিজের বাড়িতেই মৃত্যু হয় সাংবাদিকের। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার ছিল তাঁর বিয়ে। এই হামলায় ফতিমা এবং তাঁর পরিবারের দশ জন সদস্যের মৃত্যু হয়। এই হামলায় তাঁর অন্তঃসত্ত্বা বোনেরও মৃত্যু হয়েছে।
উল্লেখ্য, গাজ়ায় ইজ়রায়েলি হানা এবং তাঁর জীবনীর উপর একটি তথ্যচিত্র ফ্রান্সের ফিল্মোৎসব এবং কানের একটি ফিল্মোৎসবে দেখানো হবে বলে ফতিমার মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগে ঘোষণা করা হয়।
শৈশব থেকেই তিনি যুদ্ধ, মৃত্যু, রক্তপাত, স্বজনহারানো কান্না দেখে অভ্যস্ত। ভয়ঙ্কর এক আবহের মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে পরবর্তীকালে সেই দৃশ্য এবং ঘটনাগুলিকেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজও নিয়ে ফেলেন বছর পঁচিশের তরুণী। তিনি ফতিমা হাসৌনা। গাজ়ার চিত্র সাংবাদিক। সম্প্রতি ইজ়রায়েলি বিমানহানায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়ার একের পর এক ছবি তুলে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন এই সাংবাদিক। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে সঙ্গী করে চলা ফতিমা জানতেন, আজ নয় তো কাল মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে ছুটে গিয়েছেন গাজ়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। কখনও ইজ়রায়েলি সেনার রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ করে তুলে ধরেছেন কী ভাবে গাজ়ার বাসিন্দাদের উপর অত্যাচার হচ্ছে।
গাজার আল-তুফাহ্ এলাকায় ১৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি চিত্রসাংবাদিক ফাতিমা হাসসুনা। এই হামলায় তার গর্ভবতী বোনসহ পরিবারের আরও ১০ সদস্য নিহত হন। ফাতিমা তার বিয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে এই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণ হারান ।
১৯৯৯ সালের ১৫ এপ্রিল গাজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন ফাতিমা। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস থেকে মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে তিনি চিত্রসাংবাদিকতা শুরু করেন, যেখানে তিনি গাজার সাধারণ মানুষের জীবন, যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক সংকটের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন ।
ফাতিমা ছিলেন ইরানি পরিচালক সেপিদেহ ফারসি পরিচালিত ডকুমেন্টারি Put Your Soul on Your Hand and Walk এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই চলচ্চিত্রটি ২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের ACID বিভাগে নির্বাচিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই ঘোষণা আসার একদিন পরই ফাতিমা নিহত হন ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল হামাসের একজন সদস্য। তবে পরিচালক ফারসি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমি পুরো পরিবারটিকে চিনি। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।”
ফাতিমার মৃত্যু গাজায় সাংবাদিকদের উপর চলমান সহিংসতার একটি অংশ। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ২১৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ।
তার মৃত্যুর একদিন আগে, ১৫ এপ্রিল, ফাতিমা তার ইনস্টাগ্রামে একটি গোধূলির ছবি পোস্ট করে লেখেন: “অনেকদিন পর প্রথম সূর্যাস্ত।” তিনি আরও বলেছিলেন, “যদি আমি মারা যাই, আমি চাই আমার মৃত্যু হোক উচ্চকণ্ঠে।”
ফাতিমা হাসসুনা ছিলেন গাজার এক সাহসী কণ্ঠস্বর, যিনি তার ক্যামেরার মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের কষ্ট ও সংগ্রামের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। তার মৃত্যু শুধু ফিলিস্তিন নয়, সমগ্র সাংবাদিকতা জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.