-- বিজ্ঞাপন ---

চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ বাজারে নতুন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ

সিরাজুর রহমান#

সাম্প্রতিক সময়ে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শি জিং পিং সরকারের নতুন পরিকল্পনার আলোকে দেশের রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস/ ম্যাটারিয়ালস বা দুর্লভ খনিজ পদার্থ সম্পর্কিত প্রযুক্তির রপ্তানিতে নতুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। যার আলোকে এখন থেকে চীন তার দেশে সংরক্ষিত এই দূর্লভ উপাদান আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরণের বিধি নিষেধ আরোপ করেছে।

মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলনাম বাণিজ্য ও শুল্কো আরোপের যুদ্ধ মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তির বাজারে নিজস্ব টেকইস অবস্থান গড়ে তুলতে হয়ত এই নতুন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে চীন। যার আলোকে দেশটি এখন থেকে তাদের রেয়ার আর্থ মেটাল বা দুর্লভ খনিজ পদার্থ আহরণ, পরিশোধন ও পৃথক্‌করণ, ধাতু গলন, চুম্বকীয় উপাদান উৎপাদন, এবং দ্বিতীয় উৎস থেকে দুর্লভ খনিজ পুনঃব্যবহার সম্পর্কিত প্রযুক্তি ও তার বহনকারী উপকরণসমূহ সরকারি অনুমোদন ব্যতীত অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর কিংনা রপ্তানি করতে পারবে না। এর পাশাপাশি রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় লাইন সমাবেশ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও অনুমোদন ছাড়াই অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা যাবে না। তাছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের ‘দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য পণ্য’ (dual-use items) রপ্তানির জন্য লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করে আইন করেছে দেশটির সরকার। এই নতুন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপের ফলে দেশটির দুর্লভ খনিজ সম্পদের নিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রযুক্তি শিল্প ও বাণিজ্যের ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করে চীনের নীতি নির্ধারকেরা। যদিও চীনের রেয়ার আর্থ ম্যাটারিয়াল/ মেটাল বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রযুক্তির বাজারে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশাঙ্খা করা হয়।

২০২৪-২০২৫ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ কোটি টন বিরল-পৃথিবী ধাতুর (রেয়ার আর্থ মেটাল) মজুত থাকতে পারে। যা মধ্যে আবার প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ টন মজুত রয়েছে চীনে। অন্যান্য প্রধান মজুতকারক দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামে ২ কোটি ২০ লাখ টন, ব্রাজিলে ২ কোটি ১০ লাখ টন, রাশিয়ায় ১ কোটি টন এবং ভারতে প্রায় ৭০ লাখ টন( অন্ধ্র প্রদেশে নব-আবিষ্কৃত আনুমানিক ৭২.৩ লক্ষ টন) মজুত রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রায় ৪২ লক্ষ টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৩ লক্ষ টন এই বিরল খনিজ উপাদানের বিশাল মজুত থাকতে পারে। তাছাড়া অতি সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের বেয়লিকোভা অঞ্চলে বিশাল পরিমাণে রেয়ার আর্থ মেটালের (বিরল মৃত্তিকা মৌল) মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে বলে দাবি করা হয়, যার আনুমানিক পরিমাণ কিনা অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ৬৯.৪ কোটি মেট্রিক টন বলে উল্লেখ করা হয়। তবে তুরস্কের এই বিশাল মজুতের মধ্যে বাস্তবে rare earth oxide content হয়ত প্রায় ১%–২% থাকতে পারে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাছাড়া তুরস্কের এই দাবিটি এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে পূর্ণভাবে যাচাই ও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করে থাকেন। তবে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের এই বিপুল পরিমাণ মজুত অদূর ভবিষ্যতে তুরস্ককে ভূরাজনৈক এবং কৌশলগত সুবিধা প্রদান করতে পারে। চীন বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০–৭০% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৮৫–৯০% প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের প্রায় ৮০% এর কাছাকাছি হতে পারে। তাছাড়া গত ২০২৪ সালে এর আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৮.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩২ সালে ১৯.৬২ বিলিয়নে পৌঁছে যেতে পারে।

প্রযুক্তিনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই উপাদানের জন্য এখনো পর্যন্ত অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। তাছাড়া উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য যেমন- স্মার্টফোন, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি, এয়ারক্রাফট এবং ডিফেন্স টেকনোলজিতে ব্যবহৃত এসব উপাদানের জন্য চীনের একচেটিয়া আধিপত্ত পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক ধরনের কৌশলগত দুর্বলতা তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, চীনের এই নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক বিরল মৃত্তিকা বাজার একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এটি চীনের কেবল একটি বাণিজ্যিক নীতি নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি কৌশলগত অবস্থান বলা চলে। এর প্রভাবে অদুর ভবিষ্যতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের সাপ্লাই চেইন নিশ্চিতকরণে বিকল্প উপকরণের সন্ধানে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করবে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে, তুরস্কের মতো নতুন খেলোয়াড়দের আবির্ভাব বৈশ্বিক এই খাতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে।##