কাজী আবুল মনসুর#
ইরান একাই লড়ছে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েলের সাথে। মুসলিম দেশগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আসলে কি হতে যাচ্ছে। ইয়েমেন,লেবানন থেকে কিছুটা সার্পোট পেলেও শক্তিশালী আরব রাষ্টগুলোর কার্যত নিরব। এর পেছনে আসলে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে, যখন আরব দেশগুলো একের পর এক ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিচ্ছিল, তখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ ছিল ইসরায়েলের নির্ভরযোগ্য সহযোগী — ইরান।
তৎকালীন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ইসরায়েলকে ১৯৫০ সালেই স্বীকৃতি দেন, যা ছিল মুসলিম বিশ্বে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ।
ইসরায়েলের সাথে ইরানের বন্ধুত্ব ছিল নজরে পড়ার মতোন। আরব দেশগুলোকে অনেকটা পাস কাটিয়ে ইরান একসময় ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব জিইয়ে রেখেছিল। তাই অনেক আরব দেশ ইরানকে কার্যত ক্ষেত্রবিশেষে মেনে নিতে পারে না।
১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে ইরান ছিল পশ্চিমা ঘরানার একটি রাষ্ট্র — শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি তখন পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ মিত্র হতে চাইছিলেন।সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব থেকে বাঁচতে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমর্থন পেতে চাচ্ছিল ইরান। ইসরায়েলও তখন সদ্য গঠিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় বেড়ে উঠছিল। তাই ইরান পশ্চিমাদের খুশি করতে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ইরান যদিও মুসলিম দেশ, কিন্তু আরব নয় — বরং পারসিক জাতি। ইরানের সাথে অনেক আরব দেশের সম্পর্ক তখন ঠান্ডা এবং সন্দেহপূর্ণ।
সেই প্রেক্ষাপটে ইরান চাচ্ছিল একটি ভিন্ন কূটনৈতিক পথ ধরতে, যাতে তারা আরব দেশের তুলনায় আলাদা অবস্থানে যেতে পারে। ইসরায়েল তখন থেকে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির কাজে (কৃষি, চিকিৎসা, গোয়েন্দা) দক্ষ ছিল। ইরান চাচ্ছিল এসব উন্নয়নে ইসরায়েলের সহায়তা নিতে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা, যা মোসাদ ও সাভাক (ইরানি গোপন সংস্থা) একসাথে করত।১৯৪৮ সালে ইসরায়েল গঠনের পর আরব দেশগুলো ক্ষুব্ধ হলেও, ইরান বিষয়টিকে আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি তখন।
ইসলামি চেতনার সরকার না থাকায় ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি বা মিশরের মতো জোরালো অবস্থান নেয়নি।ইরান তখন রাজতান্ত্রিক, পশ্চিমাপন্থী, এবং আরব দুনিয়া থেকে ভিন্ন চিন্তাধারার দেশ ছিল। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে চেয়েছে, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা সুবিধা নিতে চেয়েছে, আরব প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে ভিন্ন পথে হাঁটতে চেয়েছে।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর সবকিছু উল্টে যায় — তখন থেকেই ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়। ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক ছিল কৌশলগত, গোপন ও শক্তিশালী — যার কেন্দ্রে ছিল তেল, গোয়েন্দা সহযোগিতা, প্রযুক্তি লেনদেন ও ভূ-রাজনৈতিক হিসাব। পশ্চিমা জোটের অংশীদার এই দুই রাষ্ট্র একসাথে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত প্রভাব মোকাবেলায়।
১৯৭৯ সালে ইরানে এক বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন রাজা (শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি)-এর রাজতন্ত্র উৎখাত হয় এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র (Islamic Republic) প্রতিষ্ঠিত হয়।সবকিছু বদলে যায় ১৯৭৯ সালে।
ইরানে ঘটে যায় এক ‘আত্মপরিচয়ের বিপ্লব’। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব শুধু একটি সরকারকেই উৎখাত করেনি, পাল্টে দিয়েছে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। ইসরায়েলের জন্য এ ছিল এক অভূতপূর্ব ধাক্কা — শুধু যে তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হারায় তা-ই নয়, বরং নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইসরায়েলকে ঘোষণা করে “শয়তানের রাষ্ট্র”।ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে, তেহরানে ইসরায়েল দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয় — সেখানে এখন ফিলিস্তিন দূতাবাস। প্রশ্ন উঠবেই: ইসরায়েল কি বন্ধুকে রক্ষা করতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর — চেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা ছিল নিষ্ঠুর। ইসরায়েল মোসাদের মাধ্যমে শাহ সরকারকে গোয়েন্দা সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফ্রান্সে নির্বাসিত খোমেনির ঘনিষ্ঠ নরমপন্থী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, যাতে ভবিষ্যৎ সরকার অন্তত ইসরায়েল বিরোধী না হয়। তবে এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ খোমেনি শুরু থেকেই ছিল ইসরায়েলের ঘোরতর বিরোধী।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই মুহূর্তে শাহকে পুরোপুরি সমর্থন না দেওয়ায়, ইসরায়েল একা দাঁড়ানোর সাহস পায়নি।ইরান বিপ্লব ইসরায়েলকে শুধু বন্ধুহীন করেনি, তৈরি করেছে এক ভয়ংকর শত্রু —
একটি রাষ্ট্র, যার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তিই হলো “ইসরায়েল ধ্বংস করা উচিত”।
যখন দুটি রাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ না করে, বরং অন্য দেশ, গোষ্ঠী বা মিলিশিয়াদের মাধ্যমে একে অপরকে আঘাত করে — সেটিই হয় ‘প্রক্সি যুদ্ধ’।❞মূলত দেশ দুটি এ সময় থেকে প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত (১৯৮০–২০০০) এর সময় তারা সরাসরি মুখোমুখি হয়নি, কিন্তু তারা লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, এমনকি সুদানেও নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে পরোক্ষ যুদ্ধ করেছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮) এ ইরান এই যুদ্ধে লড়ছিল,কিন্তু অবাক করার মতোভাবে ইসরায়েল ইরানকে গোপনে অস্ত্র সহায়তা দেয় (তথাকথিত Iran–Contra Affair এর অংশ)। কারণ ইরাক ছিল সেই সময় ইসরায়েলের বড় হুমকি (সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে)। এটি ছিল জটিল বাস্তবতার সূচনা — যেখানে “শত্রুর শত্রু”কেও সাময়িকভাবে বন্ধু ভাবা হয়। সেরকম কাজ অনেকটা।
ইরান-ইসরায়েলের সম্পর্ক কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না ইসলামি বিপ্লবের পর। ইসরায়েল ইরানকে সহায়তা করেছিল কৌশলগতভাবে — সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে দুর্বল করতে। কিন্তু একই সময় ইরান মনে করেছিল,“আমরা বিপদে আছি বলে ইসরায়েলের সাহায্য নিচ্ছি, কিন্তু আদর্শিকভাবে তারা আমাদের শত্রু — ফিলিস্তিনিদের শত্রু।” অর্থাৎ এটি ছিল সাময়িক সুবিধা ভিত্তিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব নয়। ইসরায়েল যখন লেবানন দখল করে, ইরান চুপ থাকতে পারেনি
১৯৮২ সালে ইসরায়েল যখন লেবাননে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালায়,হাজার হাজার মুসলিম নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান তার ইসলামি বিপ্লবী আদর্শের নামে “মজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো” নীতি নেয়।
লেবাননের শিয়ারা ঐতিহাসিকভাবেই অবহেলিত — ইরান তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করে হিজবুল্লাহ গঠন করে। ইরানের দৃষ্টিতে এটা ছিল: “ইসরায়েল এক মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে — এখন ফিলিস্তিন ও লেবাননের শিয়াদের রক্ষা করতে হবে।”
হিজবুল্লার পর হামাস। ইসরায়লও বসে নেই। ইরানে যেহেতু ইসরায়েলের অনেক পুরানো মিত্র আছে তাদের দিয়েই ইরানকে অস্থির করে রেখেছে। ইরান এখন এমন পর্যায়ে দাড়িয়ে আছে, দেশটি কি ইসরায়েলকে সামলাবে নাকি ঘরের শক্রুর মোকাবেলা করবে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.